192060

ক্ষমতার বাইরে ১১ বছর খালেদা

দুই হাজার সাত থেকে দুই হাজার সতের। টানা ১১ বছর ক্ষমতার বাইরে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। রাষ্ট্রপতি ও সেনাবাহিনী প্রধানের স্ত্রী থেকে ’৮২ সালে রাজনীতিতে আসা খালেদা জিয়ার বয়স এখন ৭৩-এর ঊর্ধ্বে। এর মধ্যে ভালো-মন্দের রাজনীতিতে ঘুরপাক খেতে হয়েছে তাকে। তবে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও দলের লাগাম এখনো শক্ত হাতে ধরে আছেন বিএনপিপ্রধান।

দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরের এই সময়ে বিএনপিপ্রধানকে সেনানিবাসের বাড়ি ছাড়া থেকে শুরু করে বালির ট্রাক দিয়ে আটকে প্রায় তিন মাস অবরুদ্ধ জীবনযাপনও করতে হয়েছে। তবে রাজনৈতিক নানা চড়াই-উতরাইয়েও হাল ছাড়েননি স্বৈরচারবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেত্রী বেগম জিয়া। ওয়ান-ইলেভেনে বড় ধাক্কায় বেশ কয়েকজন নেতা হাতছাড়া হয়ে গেলেও মাঠ পর্যায়ের কর্মী-সমর্থকরা তাকে আঁকড়ে ধরে আছে বলেই চূর্ণ-বিচূর্ণ দলটি আজও দেশের অন্যতম প্রধান ‘জনপ্রিয়’ দল। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে বিরোধীদলীয় নেতার আসনটি ধরে রাখলেও দশম জাতীয় নির্বাচন বর্জন করায় সেটিও হারিয়েছেন বেগম জিয়া। এখন শুধুই তিনি একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান। ওই নির্বাচন বর্জন করাকে বিএনপিসহ বিরাট একটা অংশই ভুল মনে করলেও দলের ক্ষুদ্র একটি অংশ বলছে, সিদ্ধান্ত সঠিকই ছিল। তবে রাজনীতিতে ‘ভুল’ করার কথা একাধিকবার স্বীকার করেছেন বেগম জিয়া। তিনি বিভিন্ন কর্মসূচিতে বলেছেন, ‘দেশ পরিচালনা এবং বিরোধী রাজনীতি করতে গিয়ে কিছু ভুল হয়েছে।’ তবে কী কী ভুল করেছেন তা স্পষ্ট করেননি বিএনপিপ্রধান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘ক্ষমতার বাইরে গত ১১ বছরে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। এর মধ্যে কমবেশি ভুলত্রুটি হয়েছে। এটা রাজনীতিতে হতেই পারে। তবে এটাও ঠিক, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে সপ্তাহে প্রায় প্রতিদিনই আদালতে যেতে হচ্ছে। এরই মধ্যে এক ছেলে মারা গেছেন। আরেক ছেলে লন্ডনে নির্বাসিত। এর মধ্যে কেউ কেউ দলছুট হলেও খালেদা জিয়া শক্ত হাতে বিএনপিকে এখন একটি শক্তিশালী অবস্থানে দাঁড় করিয়েছেন। একজন রাজনৈতিক নেত্রী হিসেবে দলের ভিতরে-বাইরে তিনি দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। এত জুলুম-নির্যাতনের পরেও তার মধ্যে কোনো প্রতিহিংসা কাজ করে না। তার মধ্যে রয়েছে সীমাহীন ধৈর্য ও সহ্যশক্তি।’ বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলছেন, বেগম খালেদা জিয়া তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এখন সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছেন। সপ্তাহের প্রায় প্রতিদিনই তাকে স্বশরীরে আদালতে হাজির হতে হচ্ছে। তিনি রাজনীতি বাদ দিয়ে এখন আদালত নিয়েই ব্যস্ত। সরকার পরিকল্পিতভাবে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। উদ্দেশ্য, খালেদা জিয়াকে ‘সাজা’ দিয়ে নির্বাচন ও রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখা।

কার্যত, শেখ হাসিনার আমল শুরু হওয়ার পর বেগম জিয়ার নেতৃত্বে চলছে ১১ বছর ধরে আন্দোলন। আন্দোলনের মধ্যেই ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো নির্বাসনে থাকা অবস্থায় মারা যান। আর বড় ছেলে তারেক রহমান সেই ২০০৮ সাল থেকেই সপরিবারে নির্বাসনে। ২০০৯ সালের মে মাসে ৪০ বছরের স্বামীর স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি ছাড়া হয়ে উঠেছেন ভাড়া বাসায়। এখানেই শেষ নয়, খালেদা জিয়া এবং তার ছেলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন আদালতে রয়েছে শতাধিক মামলা। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা বেশ কয়েকটি মামলাও চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। সব মিলেই এখন চরম প্রতিকূল পরিবেশ চলছে। সামনের দিনগুলোয় আরও বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে এ পরিবারটি। এরপরও এটা সত্য যে, এত প্রতিকূল পরিবেশেও খালেদা জিয়া কখনো বিচলিত কিংবা আদর্শচ্যুত হননি। সর্বদা জিয়ার আদর্শের ওপর অটল থেকে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করেছেন। বহু মামলা-হামলা তাকে টলাতে পারেনি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ক্ষমতার বাইরে ১১ বছরে খালেদা জিয়া কিছু মারাত্মক ভুল করেছেন, যার খেসারত এখন তাকেসহ দলকে দিতে হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো— ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের সঙ্গে আপসহীন ভূমিকা পালন করা। ওই সময় দায়িত্বরত সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে প্রকাশ্যে গালমন্দ করাও কাল হয় দলটির। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে কাজে লাগিয়ে কিছুটা সমঝোতায় এলে বিএনপিকে আজ এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি পড়তে হতো না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তা ছাড়া দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত চরম বড় ভুল ছিল। একাদশেও এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিলে দলটির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে। বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচনে অংশ নিলে নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও দলটির জয়ের সম্ভাবনা ছিল অনেক বেশি। এ ছাড়া নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টেলিফোনের ডাকে সাড়া না দিয়েও বিএনপিপ্রধান সঠিক সিদ্ধান্ত নেননি। বাংলাদেশ সফরে আসা ভারতের তত্কালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বেগম জিয়ার সাক্ষাৎ না করাও ছিল চরম শিষ্টাচারবহির্ভূত কাজ। যার খেসারত এখন তাদের দিতে হচ্ছে বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসনকে নিয়ে আমার বক্তব্য তুলে ধরা অত্যন্ত কঠিন কাজ।

তা এ জন্য যে, এর মাধ্যমে বিচারাধীন কোনো বিষয় চলে আসে কিনা। সে সম্পর্কে আমার যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তবে এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের দুই প্রতীক জননেত্রী শেখ হাসিনা ও দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মাইনাস টু ফর্মুলা দিয়ে ওয়ান-ইলেভেনের পর তাদের বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা দেওয়া হয়। এ মামলাগুলোর ক্ষেত্রে কিছু মেরিট থাকতেও পারে। কিন্তু ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের উদ্দেশ্য ছিল, দুই নেত্রীকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা। দুই নেত্রী যদি সে সময় কিছুটা কমপ্রোমাইজ করতেন তাহলে হয়তো তাদের হয়রানির শিকার হতে হতো না। তবে এখানে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কথাটি বেশি চলে আসছে। এ জন্য যে, আমরা দেখছি, তাকে এখন অনেক বেশি ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। যার কারণে দেশের বিরাট একটি অংশ দারুণভাবে ব্যথিত হচ্ছে।’ তার মতে, ‘অতীতে দুই নেত্রীর মধ্যে অনেকবার সুসম্পর্কের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল।

অথচ তা আমরা যে কোনো কারণেই হোক কাজে লাগাতে পারিনি। এখন বেগম জিয়া তার ছোট পুত্র আরাফাত রহমানকে হারিয়েছেন। বড় পুত্র তারেক রহমান লন্ডনে অবস্থান করছেন। তার বিরুদ্ধেও অনেক মামলা। আমরা অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে আশা করছি, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে সামনে রেখে দুই দল পরস্পরের মধ্যে শ্রদ্ধাবোধের জায়গাটি সৃষ্টি করবে। তা সুষ্ঠু গণতন্ত্র, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সর্বোপরি বহু রক্তের বিনিময়ে সৃষ্ট বাংলাদেশের স্বার্থেই। আমি মনে করি, গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্য দিয়ে অনেক সমস্যা দূরীভূত হবে। একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নূরুল আমিন বেপারির মতে, ‘দেশেই এখন প্রকৃত গণতন্ত্র চর্চা নেই। তাই স্বাভাবিকভাবেই ১১ বছরে রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির রাজনীতি অনেক পিছিয়ে পড়েছে। অনেক বাধা-বিপত্তি ও হোঁচট খেয়েছে। গণতান্ত্রিক রাজনীতি থাকলে নানা চড়াই-উত্রাই পেড়িয়েও বিরোধী দলের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু দেশে যখন গণতন্ত্রই থাকে না, বিনা ভোটে ১৫৪ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন, তখন বিরোধী রাজনৈতিক দলেরও কোনো কিছু করার থাকে না। তারপরও বিএনপির ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির আগে এত বেশি শক্তিক্ষয় করা ঠিক হয়নি। যেহেতু তারা নির্বাচন বর্জন করে, তাই ৫ জানুয়ারির পরে কর্মসূচি বন্ধ করাও সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না।’

সূত্র : বিডি প্রতিদিন

ad

পাঠকের মতামত