191438

শেষ বিশ্ব ইজতেমার প্রস্তুতি, সমবেত হচ্ছেন মুসল্লিরা

ডেস্ক রিপোর্ট : টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে আগামীকাল শুক্রবার শুরম্ন হচ্ছে ৫৩তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। ইতোমধ্যেই তীব্র শীত উপেক্ষা করে হাজার হাজার মুসলিস্ন ইজতেমা ময়দানে আসতে শুরম্ন করেছেন এবং খিত্তা অনুযায়ী অবস্থান নিচ্ছেন। প্রথম পর্ব শেষ হবে ১৪ জানুয়ারি। এরপর চার দিন বিরতি দিয়ে ১৯ জানুয়ারি শুরম্ন হবে দ্বিতীয় পর্ব। ২১ জানুয়ারি রোববার দ্বিতীয় পর্বের আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটবে ৫৩তম বিশ্ব ইজতেমার।

প্রথম পর্বের ইজতেমার জন্য ১৬৫ একরে পুরো ময়দানকে ২৮টি খিত্তায় ভাগ করা হয়েছে। প্রত্যেকটি খিত্তায় রয়েছে খিত্তা ও খুঁটি নম্বর। এই খিত্তা ও খুঁটি নম্বর অনুযায়ী, দেশের ৩২টি জেলার মুসলিস্নরা অবস্থান নিয়ে বয়ান শুনবেন এবং ১৪ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতে অংশ নিবেন।

গতকালও ময়দানে গিয়ে দেখা যায়, খিত্তায় খিত্তায় ও খুঁটির নম্বর লাগানো হচ্ছে। কোনো কোনো জায়গায় অসম্পূর্ণ থাকলে সেটা সম্পূর্ণ করা হচ্ছে। ইট, সুঁড়কি এবং অন্যান্য ময়লা-আবর্জনা সরিয়ে সবুজ ময়দানকে আরও সুন্দর করা হচ্ছে। শীতের কুয়াশা মাড়িয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে সব কাজ সম্পন্ন করে চলেছেন শত শত মুসলিস্ন। হিমেল হাওয়া আর তীব্র শীত যেন তাদের কাছে কিছুই নয়। ইজতেমার পুরো মাঠের জেলাওয়ারি খিত্তায় তাবলিগ জামাতের মুসলিস্নরা বুধবার থেকে অবস্থান নিতে শুরম্ন করেছেন। আজ থেকে দেশের বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত্ম অঞ্চলসহ আখেরি মোনাজাত পর্যন্ত্ম এই আসা অব্যাহত থাকবে। হাড় কাঁপানো শীত উপেক্ষা করে সারাদেশ থেকে মানুষের এই স্রোত এখন টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা মাঠ অভিমুখে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকেও মুসলিস্নরা আসতে শুরম্ন করেছেন।

এদিকে মুসলিস্নদের নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ইজতেমা ময়দান ও আশপাশের এলাকায় আট স্ত্মরের নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলেছেন। নিরাপত্তার চাদরে ডাকা রয়েছে ইজতেমা ময়দান। যাতে ইজতেমা ময়দানে কেউ কোনো নাশকতা সৃষ্টি করতে না পারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রায় ১০ হাজার পোশাকি-সাদা পোশাকি সদস্যও প্রস্তুত রয়েছেন।

আগামী ১৪ জানুয়ারি রোববার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে প্রথম পর্বের বিশ্ব ইজতেমার এই মহা ইসলামী সমাবেশ। মাঝে চার দিন বিরতি দিয়ে ১৯ জানুয়ারি থেকে শুরম্ন হবে বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব। ২১ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবারের দুই পর্বের বিশ্ব ইজতেমা। এই সমাবেশে আগত মুসলিস্নদের জন্য টঙ্গীর তুরাগ তীরে ১৬৫ একর খোলা সবুজ ও সমতল জমিনের ওপর পাটের চট দিয়ে শত শত মুসলিস্ন দীর্ঘ দুই মাস স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে সুবিশাল প্যান্ডেল তৈরি করেছেন। তাবলিগ জামাতের এই মিলনমেলায় বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের শতাধিক দেশ থেকে ৩০-৩৫ হাজার বিদেশি মেহমানসহ প্রায় ২০-২৫ লাখ মুসলিস্নর সমাবেশ ঘটবে বলে আয়োজক কমিটির মুরব্বিরা আশা করছেন। লাখো মুসলিস্নর অংশগ্রহণে শুক্রবার প্রথম পর্বের প্রথম দিন দেশের বৃহত্তম জুমার জামাত অনুষ্ঠিত হবে এই ইজতেমা ময়দানে। উপস্থিত মুসলিস্নরা ছাড়াও ঢাকা, টঙ্গী, গাজীপুর, নরসিংদী, সাভার ইত্যাদি এলাকা থেকে হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলিস্নও এই জুমার নামাজে অংশ নিয়ে থাকেন। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে।

১৯৬৭ সাল থেকে টঙ্গীর এই তুরাগ নদের তীরে নিয়মিত ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। তাবলিগ অনুসারি মুসলিস্নর সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকায় মুসলিস্নদের চাপ কমাতে ২০১১ সাল থেকে বিশ্ব ইজতেমা দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ইজতেমা মাঠে জায়গা সংকুলান না হয়ায় এ বছর থেকে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে মূল ইজতেমার কার্যক্রম।

গতকাল স্থানীয় সংসদ সদস্য মো. জাহিদ আহসান রাসেলকে স্থানীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে ইজতেমা মাঠে ইট, সুঁড়কিসহ বিভিন্ন আবর্জনা সরাতে দেখা গেছে। তিনি ইজতেমা মুরব্বিদের সঙ্গে কথা বলে বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজখবর নেন।

গাজীপুর সিটি করপোরেশন বিশ্ব ইজতেমায় আগত মুসলিস্নদের ২৪ ঘণ্টা সেবাদানে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। সিটি মেয়র এমএ মান্নান জানান, সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে প্রশাসনের নজরদারির জন্য পাঁচটি কন্ট্রোল রম্নম নির্মাণ করা হয়েছে। ইজতেমায় আগত দেশি-বিদেশি মুসলিস্নদের স্বাগত জানিয়ে আটটি তোরণ, ইজতেমার নিরাপত্তার জন্যর্ যাবের ৯টি এবং পুলিশের পাঁচটিসহ মোট ৪১টি ওয়াচ টাওয়ার ও সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। ইজতেমায় নিয়োজিত নিরাপত্তা সদস্যদের জন্য ১৫০টি অস্থায়ী টয়লেট নির্মাণ, ২০টি ফগার মেশিনের মাধ্যমে মশক নিধন কার্যক্রম গ্রহণ, ইজতেমা কর্তৃপক্ষের চাহিদা মোতাবেক ৭০ ড্রাম বিস্নচিং পাউডার সরবরাহ করা, ইজতেমা চলাকালীন সময় ২০টি গার্বেজ ট্রাকের মাধ্যমে দিন-রাত বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম নিশ্চিতকরণ, কন্ট্রোল রম্নমসমূহ ও অন্যান্য অস্থায়ীভাবে খুঁটি স্থাপনের মাধ্যমে ৪০০টি বৈদু্যতিক বাতির ব্যবস্থাকরণ, তুরাগ নদীতে নিরাপত্তার জন্য টঙ্গী ব্রিজ ও কামারপাড়া ব্রিজের নিচে দুই পার্শ্বে বাঁশ দ্বারা দুটি বেষ্টনী নির্মাণ, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের আবদুলস্নাহপুর থেকে ভোগড়া চৌরাস্ত্মা পর্যন্ত্ম দুই পার্শ্বে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও রাস্ত্মায় পার্কিং করা গাড়িসমূহ অপসারণ, ধূলাবালি নিয়ন্ত্রণের জন্য ফায়ার সার্ভিসের পানি ছিটানোর ব্যবস্থাসহ দুর্ঘটনা এবং অগ্নিনির্বাপকের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাস্ত্মার দুই পাশে দেয়ালের অশস্নীল পোস্টার অপসারণ এবং সিনেমা হলসমূহ ইজতেমা চলাকালীন সময় সম্পূর্ণ বন্ধের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে ছয়টি টেলিফোন লাইন ও দুটি হটলাইন স্থাপন, বিনামূল্যে চিকিৎসার জন্য কন্ট্রোল রম্নমের সামনে ৫৪টি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের চিকিৎসা সেবাকেন্দ্র স্থাপন এবং বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে আগত বিদেশি মেহমানদের রান্নার কাজের জন্য ১২৫টি গ্যাসের চুলা স্থাপনসহ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক মনিটর করা হচ্ছে। ১২টি উৎপাদক নলকূপ দ্বারা ১১ কি.মি. পাইপ লাইন স্থাপনের মাধ্যমে প্রতিদিন ঘণ্টায় তিন কোটি ৫০ লাখ গ্যালন সুপেয় পানি মুসলিস্নদের মাঝে সরবরাহ করা হচ্ছে।

ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানান, ইজতেমাস্থলে তাদের একটি কন্ট্রোল রম্নম স্থাপন করা হয়েছে। যেখানে সার্বক্ষণিক কর্মকর্তাসহ ফায়ারম্যানরা অবস্থান করবেন। ময়দানের প্রতি খিত্তায় ফায়ার এক্সস্টিংগুইসারসহ ফায়ারম্যান, গুদাম ঘর, বিদেশি মেহমানখানা এলাকায় তিনটি পানিবাহী গাড়ি, তিন সদস্যের ডুবুরি ইউনিট, একটি স্ট্যান্ডবাই লাইটিং ইউনিট এবং ৯টি অ্যাম্বুলেন্স থাকবে। সূত্র আরও জানায়, ইজতেমা মাঠের ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণে ইজতেমা মাঠের আশপাশের এলাকায় পানি ছিটানো হচ্ছে।

ডেসকো’ কর্তৃপক্ষ জানায়, ইজতেমা এলাকায় সার্বক্ষণিক বিদু্যৎ সরবরাহের সব প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। উত্তরা, টঙ্গী সুপার গ্রিড এবং টঙ্গী নিউ গ্রিডকে মূল ১৩২ কেভি সোর্স হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে। যে কোনো একটি গ্রিড নষ্ট হলেও সামগ্রিক বিদু্যৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হবে না বলে জানায় ডেসকো কর্তৃপক্ষ। ইজতেমা এলাকায় চারটি স্ট্যান্ডবাই জেনারেটর এবং পাঁচটি ট্রলি-মাউন্টেড ট্রান্সফরমারও সংরক্ষণ করা হয়েছে মুসলিস্নদের সার্বক্ষণিক বিদু্যৎ সরবরাহ করার লক্ষ্যে।

মুসলিস্নদের জন্য ফ্রি চিকিৎসা কার্যক্রম
গতকাল দুপুরে ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান ইজতেমা ময়দানের উত্তর পাশে মন্নু টেক্সটাইল মিলের মাঠে হামদর্দ ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প উদ্বোধন করেন। এ ছাড়াও ফ্রি-মেডিকেল ক্যাম্প এলাকায় গাজীপুর সিটি করপোরেশন, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামী ফাউন্ডেশন, ইবনে সিনা এবং টঙ্গী ওষুধ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতিসহ অর্ধ শতাধিক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইজতেমায় আগত মুসলিস্নদের ফ্রি চিকিৎসা কার্যক্রম চালু করেছে। এ ছাড়া ইজতেমায় আগত মুসলিস্নদের চিকিৎসা কার্যক্রমে সব প্রস্তুতি জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের রয়েছে। টঙ্গী সরকারি হাসপাতালে নিয়মিত শয্যা ছাড়াও অতিরিক্ত শয্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। হাসপাতালে একটি নিজস্ব কন্ট্রোল রম্নম, কার্ডিয়াক, বার্ন, অ্যাজমা, ট্রমাসহ বিভিন্ন ইফনিট খোলা হয়েছে। এ ছাড়াও টঙ্গী সরকারি হাসপাতালের উদ্যোগে টঙ্গীর মন্নুগেট, বাটাগেট এবং হোন্ডা রোডে মুসলিস্নদের তাৎক্ষণিক সেবা দেয়ার জন্য চারটি ফ্রি মেডিকেল সেন্টার খোলা হয়েছে। মুসলিস্নদের সেবা প্রদানের জন্য টঙ্গী সরকারি হাসপাতাল ও মেডিকেল সেন্টারগুলোতে ১২টি অ্যাম্বুলেন্স সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রাখা হয়েছে। হোটেলে খাবারের মান ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ম্যাজিস্ট্রেটসহ ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ভেজাল খাদ্যদ্রব্য বিক্রিতে তদারকি করা হচ্ছে।

ইজতেমায় বিদেশি মেহমান
প্রতিবছরের ন্যায় এবারও বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে প্রায় শতাধিক দেশের বিদেশি মুসলিস্ন আসবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে টঙ্গীর ইজতেমা আয়োজক কমিটির শীর্ষ মুরব্বিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইজতেমায় আগত বিদেশি মুসলিস্নদের সঠিক সংখ্যা জানাতে না পারলেও বিশ্বের অন্ত্মত শতাধিক দেশের প্রায় ৩০-৩৫ হাজার বিদেশি মেহমান এবারের ইজতেমায় অংশগ্রহণ করবেন বলে জানান। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশের প্রায় কয়েক হাজার বিদেশি মুসলিস্ন ঢাকার কাকরাইল মসজিদ, উত্তরা, টঙ্গী এবং এর আশপাশের এলাকার মসজিদে মসজিদে অবস্থান করছেন। তারা বৃহস্পতিবারই ইজতেমা ময়দানে প্রবেশ করে খিত্তা অনুযায়ী, বিছানা পেতে অবস্থান নেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রায় ৫-৬ হাজার বিদেশি মুসলিস্ন ইতোমধ্যে ইজতেমা ময়দানের নির্ধারিত তাঁবুতে অবস্থান নিয়েছেন।

ইজতেমায় বিশেষ ট্রেন ও বাস সার্ভিস
ইজতেমা ময়দানে মুসলিস্নদের যাতায়াতের সুবিধার্থে ইজতেমা শুরম্নর আগের দিন থেকে বিআরটিসির ২২৮টি স্পেশাল বাস সার্ভিস আগামী ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত্ম চলাচল করবে। বিআরটিসির একটি সূত্র জানায়, আজ থেকে ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত্ম চলাচলকারী স্পেশাল বাসের মধ্যে তিনটি বাস বিদেশি মুসলিস্নদের জন্য রিজার্ভ থাকবে।

অপরদিকে বিশ্ব ইজতেমায় আগত মুসলিস্নদের যাতায়াতের সুবিধার্থে বাংলাদেশ রেলওয়ে ২৮টি বিশেষ ট্রেন সার্ভিস পরিচালনা করবে। এ ছাড়াও সব আন্ত্মঃনগর, মেইল এক্সপ্রেস ও লোকাল ট্রেনে অতিরিক্ত ২০টি কোচ সংযোজন করা হয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, দুই ধাপের ইজতেমাতেই স্পেশাল ট্রেন চলাচল করবে। সূত্র : যাযাদি

ad

পাঠকের মতামত