191222

এক লাখ টাকায় আ.লীগ নেত্রীকে হত্যা, মিশনে নেতৃত্ব দেন ছাত্রলীগ নেতা

নবীনগরের আওয়ামী লীগ নেত্রী স্বপ্না আক্তার হত্যা মিশনের নেতৃত্ব দিয়েছে উপজেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাহিদ সরকার। আর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করতে টাকা দিয়েছে আনোয়ার হোসেন। টাকার পরিমাণ এক লাখ। হত্যা মিশনে বাইরে থেকে ভাড়া আনা হয় পেশাদার ২ কিলারকে। গ্রেপ্তারের পর পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এবং আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিতে এসব তথ্য জানিয়েছে আনোয়ার হোসেন। স্থানীয় এমপির অফিসে স্বপ্নার সঙ্গে চরম বাকবিতণ্ডার পরদিনই হত্যার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয় বলেও জানিয়েছে সে। পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে- স্বপ্নার সঙ্গে আনোয়ারের রাজনৈতিক বিরোধ, ঢাকায় দু-জনের মধ্যে ওভার শাউটিং এবং সেসময় স্ল্যাং ল্যাংগুয়েজ ব্যবহার করার ঘটনায় আনোয়ার ক্ষিপ্ত হয়ে এই হত্যা পরিকল্পনা করে। ২০শে নভেম্বর ঢাকায় আনোয়ারের সঙ্গে স্বপ্নার চরম বাদানুবাদ হয়। আর ২২শে নভেম্বর খুন হন স্বপ্না।

৪ঠা জানুয়ারি গভীররাতে ঢাকার মিরপুর এলাকা থেকে আনোয়ারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরদিন সকালে তাকে নবীনগর নিয়ে আসা হয়। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে সে হত্যার কথা স্বীকার করে। ৮ই জানুয়ারি বিকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সুলতান সোহাগ উদ্দিনের আদালতে সে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। আনোয়ার ভাঙ্গুরা গ্রামের শামসুল হক মাস্টারের ছেলে। গার্মেন্ট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আনোয়ার বছর খানেক আগে স্থানীয় সংসদ সদস্যের মনোনয়নে ভাঙ্গুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি হন। জিনদপুর ইউনিয়নের আগামী সম্মেলনে তাকে সাধারণ সম্পাদক করা হতো বলেও উপজেলা আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল এক নেতা জানান।

আর স্বপ্না চাইছিলেন আওয়ামী লীগের কাউকে সাধারণ সম্পাদক করতে। এ নিয়ে বিরোধ দেখা দেয় তাদের মধ্যে। এরপর ২০শে নভেম্বর স্বপ্না এলাকার সংসদ সদস্য ফয়জুর রহমান বাদলের ঢাকার বনানী অফিসে যান একটি ওয়াজ মাহফিলের দাওয়াত নিয়ে। দুটি মাইক্রোবাসে এলাকার ১৫/২০ জন যান স্বপ্নার নেতৃত্বে। সেখানে আনোয়ার স্বপ্নাকে দেখে তাকে না জানিয়ে কেন ঢাকা এসেছে বললে স্বপ্নার সঙ্গে তার বাকবিতণ্ডা শুরু হয়। ঢাকার ওই ঘটনার পর বাড়িতে ফিরে স্বপ্না তার জীবন শঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন। এর দু-দিন পরই খুন হন তিনি।

পুলিশ জানায়, ঢাকায় দু-জনের বাকবিতণ্ডার সময় অশ্রাব্য গালাগালও করা হয়। এর পরদিনই নাহিদ সরকারের সঙ্গে কথা বলে স্বপ্না হত্যা পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে আনোয়ার। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে আনোয়ার জানায়- নাহিদকে ৫/৬টা মামলার আসামি বানিয়েছিল স্বপ্না। সেকারণে নাহিদ স্বপ্নার ওপর ছিল চরম ক্ষুব্ধ। সেকারণে আনোয়ারের হালকা কনভিন্স, একটু সাহস ও ব্যাকআপে কাজ হয়ে যায়। আনোয়ার শুধু টাকা পেমেন্ট করবে এবং বাকি কাজ নাহিদ করবে বলে দায়িত্ব নেয়। কাকে দিয়ে ঘটনা ঘটাবে এবং কেমনে ঘটাবে এসবের কোনো কিছু আনোয়ারকে জানায়নি সে। তবে এজন্য বাইরে থেকে ২ জন লোক আনবে বলে আনোয়ারকে জানিয়েছিল নাহিদ। নাহিদ আনোয়ারকে আরো বলেছিল আপনি আপনার মতো থাকেন। আমি আমার কাজ করি। টাকা প্রদান ছাড়া বাকি বিষয় জানার ব্যাপারে আনোয়ার তেমন আগ্রহ দেখায়নি বলেও জানিয়েছে পুলিশকে।

আনোয়ার পুলিশকে আরো জানিয়েছে, এখানে এক লাখ টাকা কোনো ফ্যাক্টর না। ক্ষোভই ফ্যাক্টর। অবস্থা এমন ছিল একলাখ টাকা কেন সিএনজি ভাড়া দিলেও তারা খুন করে ফেলতো স্বপ্নাকে। আনোয়ারের কাছ থেকে পুলিশের প্রাপ্ত তথ্যানুসারে বাইরে থেকে আসা খুনিরা নিজস্ব সিএনজি নিয়ে আসে। সারাদিনই তারা স্বপ্নাকে ফলো করে এবং ফাঁক খুঁজতে থাকে। রাতে স্বপ্নাকে একা পেয়ে যাওয়াটা ছিল কাকতলীয়। কারণ স্বপ্না সব সময় লোকজন নিয়ে চলাচল করতো। তবে এভাবে না পাওয়া গেলেও তাদের কমপ্লিট প্লান ছিল ওইদিন স্বপ্নাকে খুন করার। রাস্তায় না পারলে রাতে বাড়িতে ডাকাতি করে হলেও খুন করতো তারা স্বপ্নাকে। কাজ শেষ করে খুনিরা আবার ওই সিএনজি করেই ফিরে যায়।

আনোয়ার জানায়, খুনের পর তাকে যেন কেউ সন্দেহ করতে না পারে সেজন্য সে ওইদিন এলাকায় অবস্থান করছিল। পুলিশ জানায়- ঢাকায় ঝগড়া, ওই দিন আনোয়ারের এলাকায় আসা, একজন ব্যাংক ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলা, তার ফোন বন্ধ রাখা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে আসা এসব বিষয় তদন্তে সে পুলিশের সন্দেহের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। আনোয়ার ব্যাংকে লেনদেন না করে প্রমাণ এড়াতে সরাসরি খুনের পেমেন্টের এক লাখ টাকা নিয়ে এলাকায় আসে বলে জানায় পুলিশকে। পুলিশ জানায় হত্যার বিষয়ে আনোয়ার আর নাহিদের বেশির ভাগ যোগাযোগ হতো ইমোতে। আনোয়ার পুলিশকে জানায়- তার ডায়াবেটিস রয়েছে। সেকারণে ওইদিন ঝগড়ার পর সে ক্ষিপ্ত হয়ে এই হত্যা পরিকল্পনা করে।

নবীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক স্বপ্না আক্তারকে গুলি করে হত্যা করা হয় গত ২২শে নভেম্বর রাতে। ঘটনার রাত ৯টার দিকে সাতমোড়া ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সম্মেলন থেকে ফিরে জিনদপুর বাসস্ট্যান্ডে নেমে ভাঙ্গরা বাজারে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তরা খুন করে তাকে। ওই রাতেই স্বপ্না আক্তারের ছোট ভাই আমীর হোসেন বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন। এতে যাদের সঙ্গে স্বপ্নার ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক বিরোধ আছে এমন ৬/৭ জনের নাম উল্লেখ করা হয়, তারা হচ্ছে- জিনদপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সভাপতি আলমগীর, নবীনগর উপজেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাহিদ সরকার, ভাঙ্গরা উত্তরপাড়ার আপন, ৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সাবেক সভাপতি বিল্লাল মিয়া, তার ভাই হাবলু, চারিপাড়ার সাঈদ ও নাজিম উদ্দিন। এ ছাড়া হুড়ুয়া গ্রামের সিএনজি অটোরিকশা চালক জাহাঙ্গীরের নামও সন্দেহভাজন হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এজাহারে তাদের সঙ্গে নিহত স্বপ্না আক্তারের মতবিরোধ থাকার কথা উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা সহযোগীদের দিয়ে এরা স্বপ্নাকে খুন করিয়েছে বলে বলা হয়। পরে আরো ৩ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আবেদন করেন মামলার বাদী আমির হোসেন। এ তিনজন হচ্ছে আনোয়ার হোসেন, ভাঙ্গরার নাছিম, হুড়ুরা গ্রামের শিহাব। উল্লিখিত আসামিদের মধ্যে আনোয়ারসহ ৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

আমির হোসেন জানান-মূল এজাহারেই তিনি তাদের নাম দিয়েছিলেন। কিন্তু থানার ওসি-তদন্ত নাজির আহমেদ তাদের নাম বাদ দিয়ে দেন। সম্প্রতি নাজিরকে নবীনগর থেকে বদলী করা হয়। তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলার আসামিদের রক্ষা করারও অভিযোগ আনেন স্বপ্নার পরিবার।

সূত্র: মানবজমিন

ad

পাঠকের মতামত