186352

দেশ স্বাধীনের প্রথম দুইদিন শুধু বিস্কুট খেয়ে কাটিয়েছে বঙ্গবন্ধু পরিবার

১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। দীর্ঘ ২৩ বছরের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক শোষন-বঞ্চনা আর ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ সেদিন স্বাধীনতা লাভ করে পাকিস্তানী জল্লাদ বাহিনীর কাছ থেকে। বাংলার আপামর জনসাধারণ স্বাধীনতা পেলেও তখন পর্যন্ত ধানমন্ডির ১৮ নম্বর সড়কের এক বাড়িতে অন্তরীণ ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সদস্যরা।

রেসকোর্স ময়দানে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথকমান্ডের কাছে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও ১৮ নম্বর সড়কের ওই বাড়িটি তখন ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পরাধীন এক ভূখণ্ড! পাকিস্থানী সৈন্যরা ঘিরে রেখেছিল সেই বাড়ি। এখানেই আটক ছিল বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখানো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবার। বাইরে শোনা যাচ্ছিল জনতার বিজয়ের আনন্দ উল্লাস, কিন্তু বঙ্গবন্ধু পরিবারের কাছে স্বাধীনতা ছিল অনাস্বাদিত এক বিরল নাম!

১৮ নম্বর সড়কের যে বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে অন্তরীণ রাখা হয়েছিল, তার পাহারায় ছিল প্রায় এক ডজনের মত পাকিস্তানী বাহিনীর সদস্য, যাদের সাথে ছিল রাইফেল ও হালকা মেশিনগান। ফলে তখনো কেউ জানতো না মুজিব পরিবার কোথায় আছে? পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণ করার পরও পুরো দুইদিন লেগে যায় বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে খুঁজে পেতে। ১৭ই ডিসেম্বর মেজর অশোক কুমার তারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর ডিভিশনাল কমান্ডার মেজর জেনারেল গনজালভেসের কাছ থেকে নির্দেশ পান বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের উদ্ধারের।

অবশেষে ১৭ ই ডিসেম্বর ১৯৭১, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের উদ্ধার করতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১৪ গার্ডস ইউনিট কোম্পানী কমান্ডার মেজর অশোক কুমার তারা, মাত্র তিনজন সৈন্য নিয়ে এ অভিযান পরিচালনা করেন মেজর তারা। মেজর তারা সেই বাড়ির কাছে পৌঁছার পরই বাড়ির ভেতরে অবস্থান নেয়া পাকিবাহিনীর এক সদস্য তাকে হুমকি দেয়, যে সে যদি সেখান থেকে সরে না যায়, তাহলে তাকে গুলি করা হবে।

সেই বাড়ির বাইরে পৌঁছেই মেজর তারা দেখতে পান, বুলেটে ঝাঁঝড়া হয়ে যাওয়া একটি গাড়ি পরে আছে, ভেতরে একটি মৃতদেহ। গুলির হুমকি শুনে ঘাবড়ে না গিয়ে উল্টো নিজের হাতে থাকা হাতিয়ার তার সাথে থাকা এক সৈন্যর কাছে রেখে নিরস্ত্র অবস্থায় বাড়ির দিকে এগিয়ে যান। এসময় বাড়ির ভেতর থেকে হুমকি আসে, মেশিনগানের নল তার দিকে তাক করা আছে, সে যেন আর সামনে না আগায়। কিন্তু মেজর তারা ভেতরের সৈনিকদের সাথে কথা চালিয়ে যেতে থাকেন।

এর মধ্যেই এক যুবক মেজর তারার বুকের দিকে তাক করে তার রাইফেলের বেয়নেট দিয়ে খোঁচা দিতে থাকে। এভাবে কেটে যায় প্রায় দশ মিনিট। পরে পাক সুবেদার মেজর, মেজর তারার কাছে এক ঘণ্টা সময় চাইলে মেজর তারা সেই অনুরোধে রাজি হয়ে ফিরে যেতে উদ্যত হলেই, মমিনুল হক খোকা মেজর তারাকে বলেন, যে পাকিবাহিনীকে সময় দিলেই তারা বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। এ কথা শুনেই মেজর তারা পাকিবাহিনীর সদস্যদের নিরস্ত্র করেন এবং তাদের সাধারণ পোশাক পড়িয়ে তার সাথে নিয়ে যান, তার আগে নিশ্চিত করেন যে, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সকল সদস্য নিরাপদে আছেন।

ভেতরে গিয়ে মেজর তারা দেখতে পান নবজাতক সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয়সহ শেখ হাসিনা মেঝেতে শয্যা পেতেছিলেন বন্দী থাকাকালীন সময়ে, শেষ দুইদিন কোনো খাবারও ছিল না বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কাছে। শুধু বিস্কিট খেয়ে কাটিয়েছিলেন তারা স্বাধীন দেশে দুইদিন!

২৫ শে মার্চ ১৯৭১ এর সেই কালরাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানী বাহিনী তাকে অন্তরীণ করে রাখে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল ও কলেজের এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে।বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার পর, বেগম মুজিব শেখ রাসেল ও শেখ জামালকে নিয়ে অসহায় অবস্থায় আশ্রয় নেন পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশীদের বাড়িতে।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেসময় অন্তসত্বা থাকায় শেখ রেহানাকে সাথে নিয়ে উনি আগেই চলে গিয়েছিলেন ওনার স্বামী বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী জনাব এম এ ওয়াজেদ মিয়ার ধানমন্ডির ১৫ নং রোডের বাড়িতে। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এ বাসা ও বাসা করে অবশেষে পাকিস্তান বাহিনীর সিদ্ধান্ত মোতাবেক ধানমন্ডির ১৮ নম্বর সড়কের এই বাসায় অন্তরীণ করা হয় মুজিব পরিবারকে।

১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তারা ৯৩,০০০ হাজার সৈন্যসহ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেন। এরই মাধ্যমে নয় মাস ব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের অবসান ঘটে। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পন করলেও সারা দেশে সকল পাকিস্তানি সৈন্যকে আত্মসমর্পণ করাতে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লেগে যায়।প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙালি জাতির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’। উৎস : চ্যানেল আই অনলাইন

ad

পাঠকের মতামত