185162

শাহরুখকে কপি করেন শাকিব, তবে….

প্রত্যেক মানুষই কারো না দ্বারা কারো দ্বারা প্রভাবিত। কেউ তার বাবা কিংবা মায়ের প্রভাবে নিজের জীবনকে বিকশিত করেন। কেউ বড় ভাইবোনের মতো হতে চাওয়ার চেষ্টাকেই জীবনের ব্রত করে নেন। কেউ আবার কোনো মনীষীকে করে নেন জীবনের উৎসাহ। প্রভাবিত হবার এই চর্চাকেও একরকম শিল্পের গুণ বলা যেতে পারে। তবে তাতে যদি নিজস্বতা ও গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করা যায়।

প্রভাবিত হবার এইসব গল্পে দারুণ এক সংযোজন ঢাকাই ছবির চিত্রনায়ক শাকিব খান। তার ভক্তরা কখনো তাকে শাহরুখ খান আবার কখনো সালমান খানের সঙ্গে তুলনা করেন। সম্প্রতি অপুকে ডিভোর্স কাণ্ডের পর নতুন করে আলোচনায় এসেছে শাহরুখকে ‘নকল’ করে চলা শাকিবের এই প্রবণতা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শাকিব ভক্তদের সাথে এ নিয়ে সাধারণ সিনেমাপ্রেমীদের তর্ক চলছেই। ভক্তদের দাবি, শাকিব বলিউডে জন্মালে শাহরুখদের চেয়েও বেশি জনপ্রিয় হতেন। আর বিপরীতমুখীরা বলছেন, যে নায়ক অন্য দেশের নায়কের সব কিছু কপি করে সে নায়ক কখনোই বলিউডের মতো ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে পারতেন না। শাকিবের নিজস্বতা বলে কিছু নেই।

তর্ক বিতর্ক যাই হোক, শাকিবের লাইফস্টাইলের কিছু বিষয় স্পষ্টই প্রমাণ দেয়, বলিউড বাদশাহ দ্বারা তুমুল প্রভাবিত তিনি। নিজের নাম থেকে শুরু করে পুত্রের নামেও শাহরুখের প্রভাব দেখা যায় শাকিবের। তবে আদর্শ, মানবিকতা, মূল্যবোধে শাহরুখের সঙ্গে তার যোজন যোজন দূরত্ব।

দেখে নেয়া যেতে পারে শাকিব খান তার তারকাজীবনে শাহরুখকে কতোটা অনুসরণ করেছেন। এই বিষয়ে আলোচনার প্রথমেই কথা বলা যায় নাম নিয়ে। গোপালগঞ্জে জন্ম নেয়া শাকিব খানের নাম কিন্তু এটা ছিলো না। তিনি মাসুদ রানা হিসেবেই বেড়ে উঠেছিলেন, এটাই তার পারিবারিক নাম। এই নাম নিয়েই তিনি এফডিসিতে এসেছিলেন এবং ঘুরে বেড়িয়েছেন নাচের শিল্পী হিসেবে। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৯ সালে তিনি নায়ক হিসেবে আবির্ভূত হন সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত ‘অনন্ত ভালোবাসা’ ছবি দিয়ে। সেটি মুক্তি পায় ১৯৯৯ সালের ২৮ মে। তখনই বদলে যায় নামখানা। মাসুদ রানা হয়ে উঠলেন শাকিব খান। শাহরুখের খান থাকলো উপাধি হিসেবে আর নামের শুরুতে শাহরুখের প্রথম শব্দ ‘শা’। পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান দিয়েছিলেন শাকিবের এই নাম। এক সাক্ষাতকারে শাকিব নিজেই জানিয়েছেন এই কথা।

মুসলিম হয়েও শাহরুখ ভালোবেসে বিয়ে করেছেন হিন্দু ধর্মের মেয়ে গৌরিকে। শাকিব খানও ভালোবেসে বিয়ে করেছেন অপু বিশ্বাসকে। তবে শাহরুখ তার স্ত্রীর ধর্ম পরিবর্তনের জন্য কোনো রকম চাপ বা উৎসাহ দেননি। কিন্তু শাকিব খান তার স্ত্রীকে ইসলাম গ্রহণ করতে পরামর্শ দেন এবং তার নাম রাখেন অপু ইসলাম খান।

শাহরুখ তার বসবাসের জন্য মুম্বাইয়ে বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ করেছেন ‌‘মান্নাত’ নামে। শাকিব খানও পূবাইলে একটি বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ করেছেন ‘জান্নাত’ নামে।

শাহরুখ খানের কনিষ্ঠ পুত্রের নাম রেখেছেন আব্রাম খান। শাকিব খানও তার একমাত্র পুত্রের নাম রেখেছেন আব্রাম খান। তবে শাকিব পুত্রের একটি ডাক নাম রয়েছে, জয়।

বলিউডে সালমান, আমির, ইরফান, সাঈফসহ আরও কয়েকজন নায়ক রয়েছেন যাদের নামের শেষে খান উপাধি যুক্ত। সবার থেকে শাহরুখকে আলাদা করতে ‘কিং খান’ শব্দটি ব্যবহার করা হয় সেখানে। শাকিবও নিজেকে কিং খান হিসেবে পরিচিত করেছেন। সেই নামে সিনেমাও করেছেন তিনি।

শাহরুখ খানের ছবি আছে ‘মাই নেম ইজ খান’ নামে। শাকিবও একই নামে ছবি করেছেন। আফসোসের বিষয় হলো শাহরুখ খানের ‘মাই নেম ইজ খান’ ছবিটিতে ‘মুসলামান মানেই সন্ত্রাস নয়’ এই বিষয়টির উপস্থাপন ও ইউরোপ আমেরিকাতে মুসলমানদের প্রবেশ ও থাকার ভোগান্তির চিত্র দেখে দর্শক কেঁদেছে আর শাকিবের ‘মাই নেম ইজ খান’ ছবিটি দর্শককে স্বস্তা সংলাপ আর গল্পে বিরক্তি দিয়েছে।

কিছুদিন আগে শাহরুখ খানকে নিয়ে ‘রংবাজ’ নামে একটি নতুন ছবির ঘোষণা আসে। শাকিবও শামীম আহমেদ রনির পরিচালনায় একই নামে একটি ছবি করেছেন। শাকিবের ছবিটি মুক্তি পেলেও শাহরুখের ছবিটি এখনো নির্মাণাধীন। শোনা যাচ্ছে ওই ছবির নাম বদলে যাচ্ছে।

এইসব কিছু চিত্র দেখে বোঝাই যায় নিজের নায়ক জীবনের চারপাশে শাহরুখ খানকে জড়িয়ে রেখেছেন শাকিব খান। তবে শাহরুখের মতো একজন আদর্শ মানুষ, আদর্শ স্বামী, আদর্শ পিতা, গ্রহণযোগ্য মেন্টর, সব শ্রেণির কাছে গ্রহণযোগ্যতা, নতুন প্রজন্মের কাছে আইকন হওয়ার যোগ্যতা রপ্ত করতে পারেননি শাকিব। শাহরুখের ব্যক্তিত্ব ‍ও মানবীয় গুণাবলী থেকে তিনি নিজেকে প্রভাবিত করতে পারেননি।

শাহরুখের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে কখনোই শোনা যায়নি কোনো বাজে স্ক্যান্ডাল। ‘ডন’ সিনেমা করতে গিয়ে প্রিয়াঙ্কা চোপড়াকে জড়িয়ে কিছু কথা ছড়ালেও শেষাবধি তা সিনেমার প্রচার হিসেবেই গ্রহণ করেছে দর্শক। কিন্তু শাকিব তার ছবির অনেক নায়িকা নিয়েই স্ক্যান্ডালের জন্ম দিয়েছেন। সর্বশেষ নায়িকা বুবলীর সঙ্গে শাকিবের প্রেম নিয়ে তো আলোচনা-সমালোচনার শেষই নেই। বুবলীকে বিয়ে করেছেন শাকিব সেই কথাও ছড়ানো আছে চলচ্চিত্রের বাজারে।

শাহরুখ খান দর্শকপ্রিয়তার পাশাপাশি জয় করেছেন তার অগ্রজ-অনুজ সহকর্মীদেরও মন। নতুন প্রজন্মের তারকারা তাকে আইকন হিসেবে শ্রদ্ধা করেন। নিজের অদৃশ্য মেন্টর হিসেবে দাবি করেন। কিন্তু তিন শতাধিক ছবি করা শাকিব খানকে আইকন মেনে ইন্ডাস্ট্রিতে আসা নায়ক বা তারকার সংখ্যা দূরবীন দিয়েই খুঁজে বের করতে হবে। কেউ কেউ হয়তো শাকিবের পজিশন বা চাহিদার প্রতি মোহ পুষে রাখেন, তবে তাকে মেন্টর হিসেবে মানেন সে কথা এখন পর্যন্ত কোনো তারকার মুখে শোনা যায়নি।

শাহরুখ খানের হাত ধরে দীপিকা, আনুশকার মতো তারকরা বলিউড জয় করেছেন। কাজল, মাধুরী, রানি মুখার্জি, জুহি চাওলারা পেয়েছেন শাহরুখের নায়িকা হিসেবে বিশেষ জনপ্রিয়তা। কিন্তু শাকিব খানের বেলাতে তেমনটি দেখা গেছে কেবল অপু বিশ্বাস আর বুবলীর বেলাতে। এই দুই নায়িকা ইন্ডাস্ট্রিতে একটা অবস্থান করে নিতে পারলেও সেটা কেবলই শাকিবের নায়িকা হিসেবে। দীপিকা-আনুশকাদের মতো সার্বজনীন হতে পারেননি। যদিও অপু রিয়াজ, ফেরদৌসসহ আরও দুই একজন নায়কের বিপরীতে কাজ করেছেন তবে সেগুলো আলোচনায় আসেনি। আর সেইসব ছবি সফল না হওয়ার পেছনে শাকিবের কৌশল নেপথ্যে ছিলো বলেও মনে করেন অনেকে।

শাহরুখ খান শুটিং সেটে পরিচালকের সঙ্গে তারকাগিরি প্রকাশ করেছেন সেই খবর কখনো শোনা যায়নি। কিন্তু শাকিব খান শুটিং স্পটে ‘নায়ক শাকিব’ মুডেই থাকেন সেই খবর অজানা নয় চলচ্চিত্রের মানুষদের। তার ইচ্ছেমতো শিডিউল দেয়া, শুটিং স্পটে আসা যাওয়ার অনেক খবরই গণমাধ্যমে এসেছে। এরমধ্যে গতবছর একটি ছবির মহরতে সিনিয়র অভিনেত্রী আনোয়ারা ও একঝাঁক সাংবাদিক বসিয়ে রেখেও আসেননি শাকিব। এটা তিনি অহরহই করেন। সেদিন সেখানে সাংবাদিকরা অপেক্ষা করে বিরক্ত হয়েছেন বলেই কেবল সেটি আলোচনায় এসেছিলো সংবাদের শিরোনাম হয়ে।

এখানে এই বিষয়টিও উল্লেখ করা যায়, শাহরুখ খান সিনেমার ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই বিবাহিত বলে পরিচিত ছিলেন। ক্যারিয়ারের ভয়ে তাকে স্ত্রী-সংসার আড়ালে রাখতে হয়নি। বরং স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা ও সন্তানদের নিয়ে আদর-আহ্লাদ তিনি প্রকাশ করেছেন ঘটা করেই। আর শাকিব খান ক্যারিয়ারের ভয়ে আট বছর গোপন রেখেছেন বিয়ের খবর।
শাহরুখ খানের ব্যস্ততা নতুন করে বলার কিছু নেই। সিনেমা, নানারকম ব্যবসা নিয়ে দিন কাটে তার। এসবের মাঝেও সময় পেলেই পরিবার নিয়ে ঘুরতে বের হন তিনি। স্ত্রী, পুত্র-কন্যাদের নিয়ে অবকাশ যাপন করেন সাধারণ একজন মানুষের মতোই। আর শাকিব খান বিয়ের খবরটাই রেখেছিলেন গোপন। সিনেমার ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে সন্তান জন্মের সময় স্ত্রীর পাশে থাকেননি। প্রথমবারের মতো ছেলের মুখ দেখেছিলেন প্রায় চার মাস পর!

নিজে শুটিংয়ের টানে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ালেও বিয়ের খবর প্রকাশ্যে আসার পর কখনো শোনা যায়নি স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে বেড়িয়েছেন। চলতি বছরের দুটি ঈদের একটিতেও শাকিবকে দেখা যায়নি স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে। পুত্রের মার্কেট করে দিয়েই তিনি সাংসারিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

প্রায় সময়ই দেখা যায় শাহরুখ তার বাবা ও মাকে নিয়ে নানা রকম আবেগঘন মন্তব্য করেন। সেইসব মন্তব্য নতুন প্রজন্মকে উৎসাহ দেয় মা-বাবা ও পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে। কিন্তু শাকিব খানের পরিবার সম্পর্কে তার ভক্তরা তেমন কোনো তথ্য জানে না বললেই চলে। তিনি জনপ্রিয়তা পেলেও তার পরিবার ও পরিবারের মানুষেরা থেকে গেছে আড়ালেই। যার কারণে পারিবারিক বা সামাজিক মূল্যবোধের জায়গাটিতে কখনোই শাকিব প্রভাব ফেলতে পারেননি বলে ধারণা অনেকের।

শাহরুখের প্রতি শাকিবের দুর্বলতা গোপন কিছু নয়, বেশ প্রকাশ্যই বলা চলে। তবে শাহরুখের মানবীয় গুণাবলী তিনি এড়িয়ে চলেছে হতাশাজনকভাবে। শাহরুখের ব্যক্তিত্ব তিনি রপ্ত করতে পারেননি, হয়তো চেষ্টাও করেননি। সেরা নায়ক আর সুপারস্টার ঘোরেই কেটে যাচ্ছে তার দিনগুলো। পরিণত হয়েছেন অভিনয়ে, তামিল হিরোদের স্টাইল-ফ্যাশন আর লুক কপি করে; পরিণত হতে পারেননি জীবনবোধের ভাবনা ও দর্শনে।

প্রায়ই মনে হয়, নায়ক হিসেবে জনপ্রিয়তার যে চূড়ায় তিনি উঠেছেন তার সঙ্গে নিজের বিনয় ও মানবীয় গুণগুলোকেও শাকিব যদি নান্দনিকতার চূড়ায় নিয়ে যেতে পারতেন হয়তো বাংলাদেশ অসাধারণ কাউকে পেতো। হয়তো ঢাকাই ছবির ইন্ডাস্ট্রি একটা কালজয়ী নাম পেত, যাকে সম্মান করা যায় নত হৃদয়ে। হয়তো নতুন প্রজন্মের স্বপ্নই হতো সাকিব আল হাসানের মতো শাকিব খান হতে পারাটাও।

কিন্তু সেই হয়তো আটকে রইলো আফসোসেই!

ad

পাঠকের মতামত